মঙ্গলবার, ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ১৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

কক্সবাজার জেলা

কক্সবাজার শত্রুমুক্ত দিবসের অনন্য ইতিহাস

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজার হানাদারমুক্ত হয়। এই দিনে কক্সবাজার শহরের পাবলিক লাইব্রেরির শহীদ দৌলত ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল কক্সবাজার শত্রুমুক্ত হওয়ার সংবাদ।

সকালে চারটি গাড়িবহর নিয়ে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করেন মুক্তিযোদ্ধারা। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুস ছোবহান, যিনি তখন কক্সবাজার–বান্দরবনের অধিনায়ক। শহরে এসে তিনি জনতার উদ্দেশে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তাঁর সঙ্গে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আগমনে পুরো শহর যেন উৎসবের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। হাজারো মানুষ দৌড়ে আসে মাঠে, কেউ আনন্দে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ওঠে, আবার কেউ শ্লোগানে মুখর করে তোলে চারদিক।

সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণে ক্যাপ্টেন ছোবহান তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে কক্সবাজার-বান্দরবন’ গ্রন্থে লিখেছেন-প্রভাতেই রত্নাপালং ক্যাম্প থেকে চারটি বাসে যাত্রা শুরু হয় কক্সবাজারের দিকে। মরিচ্যা বাজার পার হওয়ার সময় দেখা যায় মানুষের ঢল-হাজারো মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতার শ্লোগানে কাঁপিয়ে তুলছে বাতাস। সবাই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে দু’হাত উঁচু করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। শহরে প্রবেশের পর হাশেমিয়া মাদ্রাসা এলাকায় গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চার দলে ভাগ হয়ে পুরো কক্সবাজার ঘিরে ফেলে, যাতে শত্রুবাহিনী কোথাও অবস্থান করতে না পারে।

পাবলিক লাইব্রেরির মাঠে পৌঁছালে সেখানে মানুষের ঢল নেমে আসে। স্বজন হারানো মানুষের কান্নায়, আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কেউ নিজের হারানো সন্তান, স্বামী বা ভাইয়ের কথা বলতে বলতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছিল। এই আবেগঘন মুহূর্তে জিপের ওপর দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন ছোবহান বক্তব্য দিতে গিয়ে নিজেও আবেগে ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, যারা শহীদ হয়েছেন, তারা বৃথা যাননি; তাদের রক্তের বিনিময়ে আজকের এই স্বাধীনতা। তিনি স্মরণ করেন কক্সবাজারের শহীদ ছাত্রনেতা সুভাষ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা ফরহাদ এবং অ্যাডভোকেট জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরীকে যাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদাররা। তিনি বলেন, তাদের রক্তেই আজ কক্সবাজার মুক্ত, তাদের আত্মত্যাগই স্বাধীনতার আলো এনেছে।

সেদিনের সেই উত্তাল বিকেল, মানুষের আবেগ, শ্লোগান আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, সব মিলিয়ে ১২ ডিসেম্বর কক্সবাজারের ইতিহাসে অম্লান হয়ে আছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই দিনটি পালনের উদ্যোগ আজ কম দেখা যায়, তবুও ইতিহাসের পাতায় কক্সবাজার শত্রুমুক্ত দিবস চিরকাল সম্মান আর গৌরবের সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই দিনের বিজয়ের ধ্বনি ধ্বনিত হয়েছিল ১৬ ডিসেম্বরের চূড়ান্ত বিজয়ের সূর্যোদয়ের আগমনী সুর হিসেবে।

ক্যাটাগরি